জীবনানন্দ দাশ। এবং তাঁর ডায়েরি। আমাদের সাম্প্রতিক আলোচনার অন্যতম বিষয়। অন্তত সামাজিক মাধ্যমের দেওয়ালে দেওয়ালে। ডায়েরি এমন একটি বিষয়। যেখানে পর্দা সরিয়ে উঁকি দেওয়া যায়।
ফলে নিজে ডায়রি লেখার থেকেও অন্যের ডায়রির পাতা উল্টাতে আমাদের স্বাভাবিক উৎসাহ এবং আগ্রহ সীমাহীন। এবং তিনি যদি বিখ্যাত কেউ হন। জীবনানন্দের সৌভাগ্য। তিনি সেই অর্থে মস্ত বড়ো কোন পুরস্কার প্রাপ্তির হাত ধরে জনপ্রিয় হননি। তাঁর জনপ্রিয়তা সীমাবদ্ধ, সাহিত্যরসিকদের ভিতরে। সমাজের বৃহত্তর অংশে তাঁর তেমন পরিচিতি নেই। স্কুলপাঠ্য রূপসীবাংলার খান কয়েক কবিতা পেরিয়ে তিনি খুব একটি পরিচিত নন তেমন। হ্যাঁ, তাঁর ও তাঁর কবিখ্যাতির ভিতরে বনলতা সেনের একটা বিশেষ এবং অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা রয়েছে বইকি। সে কথা অস্বীকার করার উপায় নাই কোন। বনলতা সেন কবি জীবনানন্দ এবং তাঁর কবিখ্যাতির ভিতরে প্রধানতম একটি সাঁকো। সেই সাঁকো দিয়েই আমাদের অধিকাংশ বাঙালির তাঁর সাথে পরিচয়। স্কুলপাঠ্য সিলেবাসের বাইরে। এর বেশি আগ্রহ। অন্তত কবি জীবনানন্দ সম্পর্কে আমাদের খুব একটা আছে বলে মনে হয় কি?
যদি থাকতো। তাহলে যে কয়টি লক্ষ্মণ আমাদের ভিতরে দেখা যেত। তার অন্যতম কয়েকটি হলো। বাঙালির ইতিহাস চেতনায় একটা আমূল পরিবর্তন আসতো। যেটা আদৌ আসে নি। বাঙালির কালচেতনা। যা ইতিহাস চেতনারই অনুসঙ্গ। এমন নড়বড়ে অবস্থায় পড়ে থাকতো না। বাঙালির সামাজিক চেতনা আজকের মত এমন ভয়াবহ ভাবে রাজনৈতিক দলগুলির পারস্পরিক রাজনৈতিক জমি ও ক্ষমতা দখলের লড়াইয়ের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রীত হতো না। সমাজের দিশা ও অভিমুখ অন্যতর আলোকমুখী হতে পারতো। এবং মানুষ হিসাবে বাঙালির ভিতরে সংবেদনশীলতার চর্চা অনেক বেশি সুদৃঢ় হতে পারতো। কিন্তু আমাদের বর্তমান অবস্থা ও পরিচয় কোনটির সাথই জীবনানন্দের ইতিহাস চেতনা কালচেতনা সমাজচেতনা এবং সংবেদনশীলতার সুদূরতম সম্বন্ধ গড়ে ওঠেনি। না প্রত্যেককেই তার জন্য সাহিত্যরসিক হতে হবে। তার কোন অর্থ নাই। ব্যক্তিজীবনে সাহিত্যরসিক না হলেও। আমাদের শিক্ষায় ও দীক্ষায় ইতিহাসচেতনা কালচেতনা সমাজচেতনার দিগন্ত সুস্পষ্ট এবং গভীর। বিস্তৃত এবং নিবিড় হওয়ার প্রয়োজন রয়েছে বইকি। অন্তত নিজেকে স্বঘোষিত শিক্ষিত শ্রেণীর একজন বলে দাবি ও বিশ্বাস করতে শুরু করলে। বরং সংবেদনশীলতার চর্চার জন্য ঘরে ঘরে অনার্স মাস্টার্স পিএইচডি ডিগ্রী অর্জনের কোন প্রয়োজন হয় না। বংশানুক্রমিক ঐতিহ্যে লেখাপড়ার সাথে সংযোগ না থাকলেও মানুষের ভিতরে সংবেদনশীলতার লক্ষ্মণ ও পরিচয় থাকতেই পারে। এবং থাকেও। কেতাবী শিক্ষা দীক্ষার বাইরে থাকা মানুষের ভিতরেই বরং সংবেদনশীলতার পরিচয় তুলনামূলক ভাবে বেশি থাকে।
স্বভাবতই অনেকেই বলবেন। একজন কবি’র পক্ষে একটি জাতির কিংবা কোন সমাজের আমূল পরিবর্তন করা যদি সম্ভবই হতো। তবে রাজনৈতিক বিপ্লবের প্রয়োজন হতো না। ইতিহাসে এমন কোন সাক্ষ্যও নেই। যেখানে কোন একজন কবি। তাঁর লেখনী দিয়ে সমাজ পাল্টে দিচ্ছেন। সমাজের অভিমুখ ঠিক করে দিচ্ছেন। কোন ভুল নেই। কথাটি একশো শতাংশ সত্য। তা হয় না। তা হয়ও নি। কিন্তু যে কোন সমাজেই কবি সাহিত্যিকদের একটা প্রভাব থাকে। থাকার কথাও। আমাদের সমাজে রবীন্দ্র নজরুলের একটা প্রভাব ছিল এক সময়। বেশ প্রবল ভাবেই। না সমাজের সকল শ্রেণীর ভিতরে নয়। শিক্ষিত শ্রেণীর একটা ছোট অংশের উপরে। কিছুটা হলেও প্রভাব পড়েছিল। না পড়লে আমাদের সাহিত্য সংস্কৃতি আজকের রূপ পেত না। আবার ইতিহাসের দিকে ফিরে তাকালে। দেখা যাবে। ব্রিটিশ নিয়ন্ত্রীত সময়ের পূর্বে এই বাংলার সমাজজীবনে কবি থেকে কবিয়াল। সাধক থেকে মহাকবি। সমাজজীবনে ও লোকশিক্ষায়। তাঁদের প্রভাবের একটা ঐতিহাসিক উত্তরাধিকার গড়ে উঠেছিল বইকি। সেই উত্তরাধিকারের পথরেখায় বঙ্গসমাজের অভিমুখ নির্ধারিত হোক না হোক একটা বিশিষ্ট রূপ গ্রহণ করেছিল। যাকে আমরা বাঙালিত্ব বলে নির্দেশ করতে পারি।
না, বঙ্গসমাজে জীবনানন্দের তেমন কোন প্রভাব পড়েনি। পড়ার কথাও নয়। তিনি বিদেশ থেকে কোন পুরস্কার অর্জন করেনি। তিনি রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অংশ নিয়ে কিংবা বাজেয়াপ্ত বইয়ের কারণে কখনো কারাবরণ করেনি। তিনি সুরকার গীতিকার গায়কও ছিলেন না। অর্থাৎ জনপ্রিয় হয়ে ওঠার প্রাথমিক কোন ঘটনা তাঁর জীবনে ঘটেনি। একজন নিভৃতবাসী সাধক সম্বন্ধে জনগণের ভিতরে যেমন বিশেষ আগ্রহ জন্মানোর সুযোগ ঘটে না। জীবনানন্দের ক্ষেত্রেও তেমনই জনগণের ভিতরে বিশেষ আগ্রহ গড়ে ওঠার সুযোগ ছিল না। কিন্তু এই একজন মানুষ। মৃত্যুর অব্যবহিত সময়ের পর থেকেই, বাঙালি সাহিত্যসাধকদের উপরে প্রায় ভুতের মতোনই চেপে বসে পড়েছিলেন। অন্তত বেশ কয়েক দশক। তার ভিতরে একদল প্রবল ভাবে তাঁর প্রভাব কাটিয়ে ওঠার চেষ্টা যেমন করেছিলেন। তেমনই আর একদল জীবনানন্দের বৃত্তেই নেশাগ্রস্তের মতোন ঢুলতে শুরু করেছিলেন। না, এই দুই দলের অধিকাংশই জীবনানন্দের ইতিহাসচেতনা কালচেতনা এবং সমাজচেতনার অংশীদার হয়ে ওঠেননি। চলমান রাজনৈতিক ঢেউগুলির ঘূর্ণিতেই তাঁরা আবর্তিত হয়েছিলেন। সেই আবর্তনকে ইতিহাসচেতনায় কালচেতনা ও সমাজচেতনায় প্রত্যক্ষ করতে সফল হননি তেমন। স্বল্প কয়েকজন ব্যাতিক্রমী লেখক কবি ছাড়া। ফলে সামগ্রিক ভাবে বাংলা সাহিত্যও জীবনানন্দের প্রভাব থেকে সেই অর্থে বিশেষ পুষ্টি লাভ করে সমৃদ্ধ হয়ে উঠতে পেরেছিল কিনা। সেই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ রয়েছে যথেষ্ঠ। এই বিষয়ে সঠিক চিত্র পেতে আরও বেশ কিছু দশক পারি দিতে হবে আমাদের।
এহেন জীবনানন্দের অপ্রকাশিত ডায়েরি। এতদিন পরে বাঙালি সাহিত্যসমাজের হাতে এসে পড়েছে। অনেকটা কৌরবের রাজসভায় দ্রৌপদীর মতন দশা আর কি। সকলেই সেই ডায়রির মলাট উল্টে মানুষ জীবনানন্দের খোঁজে উদগ্রীব। অর্থাৎ আমারা ধরেই নিচ্ছি কবির সাহিত্যভুবনে নয়। কবিকে খুঁজে পেতে গেলে। তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরিই শেষ ভরসা। এই এক বিশ্বাস। অধিকাংশ মানুষের ভিতরে বদ্ধমূল হয়ে থাকে। দেশ কাল সংস্কৃতি নিরপেক্ষ ভাবে। ফলে দেখা যায়। বিখ্যাত মানুষের ডায়রির বিষয়ে আমাদের আগ্রহ সীমাহীন। এবং আমরা মূলত ধরেই নিই। ডায়রি মানেই যেন, গীর্জার সেই কনফেশন কিউব। যেখানে মানুষ সত্য বই মিথ্যে বলে না। কিংবা কল্পনা ছলনার আশ্রয় নেয় না। কল্পনা কিংবা ছলনার আশ্রয় না নিয়ে, সত্যকে বেআব্রু করে প্রকাশ করতে চায়। অর্থাৎ ডায়রি মানেই অপ্রকাশিত সত্য। কিন্তু বেআব্রু সত্য। আমাদের আগ্রহ এই সত্য সম্বন্ধে নয়। আমাদের আগ্রহ বেআব্রু সত্য সম্বন্ধে। এইখানে মানুষ হিসাবে আমাদের একটা সত্য পরিচয়।
ঠিক সেই পরিচয়ের একটা পরিস্কার চিত্র সম্প্রতি বেআব্রু হয়েছে। সমাজিক মাধ্যমে। আলোচনার সূত্র। কবি জীবনানন্দ নন। আলোচনার সূত্র সম্প্রতি প্রকাশিত তাঁর অপ্রকাশিত ডায়রি। সেই ডায়রির পাতায় পাতায় এক অন্য জীবনানন্দের খোঁজে মানুষ জড়ো হয়েছে। উৎসাহে উদ্দীপন্নায় উদগ্রীব হয়ে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে। আমাদের আগ্রহ জীবনানন্দের কবিসত্তা নিয়ে নয়। জীবনানন্দের ব্যক্তিসত্তা নিয়েও নয়। জীবনানন্দের চেতনার দিগন্ত নিয়েও নয়। যে ডায়রির পাতায় পাতায় এই বিভিন্ন এবং পরস্পর পরিপূরক সত্তার চালচিত্র থাকাই স্বাভাবিক। আমাদের যাবতীয় আগ্রহ গিয়ে পৌঁছিয়েছে কবি নয়, মানুষ জীবনানন্দের যৌনসত্তায়। ব্যক্তি জীবনানন্দের শরীর ও দাম্পত্যের মধ্যেখানে তাঁর যৌনসত্তার যে সাঁকো। সেই সাঁকোতেই বাঙালি সাহিত্যরসিকদের ভিড় আজ সবচেয়ে বেশি। না, জীবনানন্দ অবাঙালি হলে যে এই ভিড় কম হতো তা নয়। তিনি অন্য কোন দেশের, অন্য কোন জাতির, অন্য কোন ভাষার কবি হলে যে সেই দেশে, সেই জাতির, সেই ভাষার মানুষের ভিড় কম হতো। বিষয়টি তেমনও নয়। দেশ কাল সংস্কৃতি নিরপেক্ষ ভাবেই মানুষের স্বাভাবিক আগ্রহ থাকে, অন্যের ডায়রির ভিতরে উঁকি দেওয়া।
আমরা তাই আজ আমাদের নিভৃতচারী কবির যৌনসত্তাকে তাঁর ডায়রিতে খুঁজে পেয়ে উৎসাহে এবং উদ্দীপনায় বিভোর হয়ে উঠেছি। ঠিক কোন কেন মহীয়সী রমনীর কল্পনায় তাঁর যৌনসত্তা উজ্জীবিত হয়ে উঠতো। তাঁদের নাম ধাম পরিচিতি নিয়েও আমাদের কম আগ্রহ নয়। কবি তাঁর দাম্পত্য সম্পর্কের ভিতরে আপন যৌনসত্তার পরিপূর্ণ উদ্বোধন ঘটাতে পারতেন কি, পারতেন না। কবিমনের অবচেতনের যৌনতৃষ্ণার গতি ও প্রকৃতি কিরকম ছিল। কি কি ভাবে ও কোন কোন শারীরীক প্রক্রিয়ায় সেই তৃষ্ণা নিবারণ করতেন রক্ত এবং মাংসের জীবনানন্দ। আমাদের যাবতীয় আগ্রহ ঠিক সেই দিকেই। আমরা আলোচনা করছি। কবি হলেও তিনি যে মানুষ। এই ডায়রিতে লেখা তাঁর নিজের যৌনজীবনের যৌনচেতনার যৌনতৃষ্ণার আখ্যান সেই সত্যকেই তুলে ধরছে বলে। আর তখনই যেন আমরা নিশ্চিত হচ্ছি। কবি হলেও জীবনানন্দ দাশও আমাদের মতোই রক্তমাংসেরই মানুষ ছিলেন। তবে কি, তাঁর কবিতা তাঁর সাহিত্যকীর্তির ভিতরে দিয়ে আমরা কোন রক্তমাংসের মানুষের হদিশ পায়নি তবে এতদিন? শুধুই শব্দের কারুকাজ ছিল তাঁর যাবতীয় লেখা ও লেখনী? এইবারে সেই লেখা ও লেখনীকে এই ডায়রির পাতায় পাতায় মিলিয়ে পড়লে তবেই আমরা পৌঁছাতে পারবো জীবনানন্দের অন্দরমহলে?
এই এক রোগ মানুষের। সাহিত্য নয়। কবিখ্যাতির জৌলুসে মত্ত হয়ে আমরা এক রক্তমাংসের কবির দৈনন্দিন জীবনযাপনের অন্দরমহলে উঁকি দিতে অনেক বেশি উদগ্রীব। আমরা অনেক বেশি স্বস্তি পাই। কবির ব্যক্তিজীবনের শরীর ও মনের গতি ও প্রকৃতির সাথে নিজেদের শরীর ও মনের গতি ও প্রকৃতির মিল খুঁজে পেলে। কবিরচেতনায় নয়। কবির জীবনবোধের দিগন্তে নয়। কবির সৃস্টিকর্মেও নয়। আমরা আমাদের কবিকে অনুভব করতে চাই। খুঁজে পেতে চাই। বুঝে নিতে চাই। তাঁর প্রতিদিনের শরীরের টুকরো টুকরো গল্পগুলির ভিতরে দিয়ে। তাঁর মনের আলোঅন্ধকার গলিঘুঁজিতে অবাধে ঘুরে ফিরে। তাঁর অবচেতন স্বপ্নের গভীরে ডুব দিয়ে। যতক্ষণ না পর্য্যন্ত একজন রক্ত এবং মাংসের কবিকে আমরা আমাদের জীবনযাপনের দর্পনে প্রত্যক্ষ করে নিতে পারছি। ততক্ষণ আমাদের তৃপ্তি নেই। স্বস্তি নেই। শান্তি নেই।
বেশ তো আমরা তো সব জেনেই গেলাম। সেই রক্ত এবং মাংসের জীবনানন্দের অপ্রকাশিত ক্রিয়াকর্মগুলি। যেগুলি দিয়ে আমরা নিজেদের জীবনকে সাজিয়ে রাখি। নিরালায় নিভৃতে। সেই একই ক্রিয়া এবং কর্ম দিয়ে কবি জীবনানন্দের ব্যক্তিজীবনের অন্দরমহলে পা রেখে আমাদের নতুন কোন বোধদয় হলো? অন্যের বেডরুমে উঁকি দেওয়ার তৃপ্তিটুকু ছাড়া। সেই হিসেবনিকেশটুকুও করে দেখা উচিত বইকি। এই এক তৃপ্তি। অন্যের বেডরুমে। অন্যের বাথরুমে। অন্যের নাইটল্যাম্পের আলোয় তাকে প্রত্যক্ষ করার মানসিকতা। এই মানসিকতাকেই বলা যেতে পারে নাবালকত্ব। আমরা বিশেষত বাঙালি জনসম্প্রদায় ঐতিহ্যগত ভাবেই এই নাবালকত্বের উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। আমাদের আড়ালও চাই। আবার আড়ালের ভিতরে উঁকি দেওয়াও চাই। ফলে যৌনতা আমাদের জীবনে সবচেয়ে বড়ো একটি বিষয়। অবশ্যই সমগ্র জীবজগতেই যৌনতাই প্রধানতম বিষয়। সেই বিষয়ে তর্কও চলে না। কিন্তু জীবজগত যে বিষয়টিকে জীবনের স্বাভাবিক একটি প্রকাশ বলে অনুধাবন করতে পরেছে। দুর্ভাগ্যের কথা অধিকাংশ জন সম্প্রদায়ই সেই ক্ষমতা অর্জন করতে সক্ষম হয়নি আজকের দিনে এসেও। এবং এই অক্ষমতা ঐতিহাসিক ভাবেই সত্য। ঐতিহাসিক ভাবেই এই অক্ষমতা আমরা বিশেষ করে, বিশেষ বিশেষ সম্প্রদায় উত্তরাধিকার সূত্রে বহন করে চলেছি। পৃথিবীর প্রায় সব কয়েকটি রিলিজিয়ন এই উত্তরাধিকারকে অতি যত্নে লালন এবং পালন করে চলেছে। যে যে সমাজে রিলিজিয়নের প্রভাব যত বেশি সর্বাত্মক। সেই সেই সমাজে মানুষের ভিতরে এই অক্ষমতা তত বেশি মারাত্মক হয়ে দেখা দেয়। সমাজ সংসারে যার ছাপ পড়তে থাকে সর্বত্র।
আমরা বাঙালিরাও তাই ব্যতিক্রম নই। বরং অত্যন্ত প্রবল ভাবেই এই অক্ষমতার ধারক এবং বাহক। ফলে শরীর ও মনের ভিতরে যৌনতার প্রকাশকে আমরা এমনই খর্ব করে রাখতে চাই। এমন প্রবল ভাবেই ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চাই। যে ভিতরের যৌনতৃষ্ণার আগ্নেয়গিরি আমাদেরকে কোন সময়েই স্বস্তিতে থাকতে দেয় না। এক অস্থির দিশাহীন যৌন আবেগ আমাদের জীবনকে তাড়িয়ে নিয়ে চলতে থাকে। আমাদের পেটে খিদে। মুখে লাজ। আমাদের আকাঙ্খায় সব কিছুই বর্তমান। কিন্তু আমাদের ভাষায় ও ভাবে কোন কিছুই স্বাভাবিক ভাবে প্রকাশিত নয়। স্কুলপাঠ্য নীতিশাস্ত্রে আমরা সুবোধ মুখোশে নিজেদের ঢেকে রাখি। কিন্তু মনের অলিতে গলিতে খ্যাপা খুঁজে ফেরে পরশ পাথর। সেই পরশপাথর খোঁজার বাসনা থেকেই অন্যের ডায়রির মলাট উল্টানোর বিষয়ে আমাদের এত আগ্রহ। এদিকে নিজের শরীরকে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগে জড়িয়ে রাখতে আমাদের লজ্জা। অন্যের শরীরকে সেই আবেগে অনুভব করতে আমাদের অক্ষমতা। ফলে বিপরীত লিঙ্গের শরীর আমাদের নগ্ন চেতনায় লালসার সামগ্রী হয়েই রয়ে যায়। আর যে কোনভাবেই হোক। সেই লালসা মিটে গেলেই। সেই বিশেষ শরীর সম্বন্ধে আমাদের আকর্ষণের সমাপ্তি ঘটে যায়। দাম্পত্যেই হোক। আর পরকীয়াতেই হোক। এমনই এক খর্ব, অপরিপক্ক, অপরিণত এক যৌনচেতনার উত্তরাধিকার বহন করে চলেছি আমরা। যার ফলে এক কপট ভদ্রতার খোলসেই আমাদের যাবতীয় সামাজিকতা। যার তলায় সীমাহীন লালসা। আর সময় ও সুযোগ পেলেই উচ্ছৃঙ্খল লাম্পট্য।
না, আমাদের যৌনতাবোধ আজও নাবালকত্বের সীমানা ডিঙিয়ে উঠতে পারেনি। ফলে এই এক অপ্রাপ্তবয়স্ক মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ ব্যক্তি ও সমাজ জীবনের সর্বত্র। সর্বাত্মক। এবং ক্ষেত্রবিশেষে মারাত্মক। সব সময়েই যে তা অন্যের জীবন ধ্বংস করে তাও নয়। অনেক সময়। বলা ভালো অধিকাংশ সময়েই এই নাবালকত্ব আমাদের নিজেদের জীবনকেই ধ্বংস করে। ধ্বংস না করলেও জীবনকে পরিপূর্ণ ভাবে বিকশিত হতে দেয় না। ফলে সেই অপ্রাপ্তবয়স্ক মানসিকতায় আমরা যখন কোন এক জীবনানন্দের ডায়রির মলাট উল্টাই। তখন আমাদের চোখে পড়ে শুধুই একটা রক্ত আর মাংসের পিণ্ড। সেই ডায়রির পাতায় পাতায় যে সমগ্র জীবনানন্দের দলিল রয়ে গিয়েছে। রেখে গিয়েছেন আমাদেরই কবি। স্বহস্তে। সেই সমগ্র দলিলের বিষয়ে আমাদের উদাসীনতা তিলমাত্র কমে না। কমবেই বা কি করে? নাবালকত্বের সীমানায় যাদের চলাচল। সামাজিক নীতিশাস্ত্রের ঘেরাটপে বন্দি থাকা চোখ। সময় ও সুযোগ পেলেই এদিক সেদিক উঁকিঝুঁকি দিতে তো থাকবেই।
৭ই ফেব্রুয়ারী’ ২০২২
কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত