“এক”
বিশ্বের যেকোন সমাজ বা জাতির জন্যই একথা সত্য। সেই জাতি কিংবা সমাজই টিকে থাকে, যেখানে প্রশ্ন তোলার চলটুকু অন্তত সজীব থাকে। আর নিরন্তর প্রশ্ন তোলা। আর নিরন্তর সেই প্রশ্নের সঠিক উত্তরের সন্ধানের ভিতর দিয়েই কোন সমাজ বা কোন জাতির অগ্রগতি ঘটে, ঘটতে থাকে। এ আসলেই প্রকৃতির বিধান। এবং এইখানেই জীবজগতে মানুষের অনন্যতা। বাকি অধিকাংশ বিষয়ে মানুষ জীব জগতের অন্যান্য প্রাণী’র প্রায় সমধর্মী হলেও। এই একটি জায়গায় সে বাকি সব জীবের থেকে আলাদা। অনন্য এবং সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী।
অতি প্রাচীন কালে যে যে অঞ্চলের মানুষ এই প্রশ্ন তোলার কাজটি শুরু করেছিল। সেই সেই অঞ্চলেই মানুষ সভ্যতা গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিল। যে সময় মিশরে পিরামিড স্থাপিত হচ্ছিল। সেই সময়ে বিশ্বের অধিকাংশ অঞ্চলের মানুষই এই প্রশ্ন তোলার মতো বৌদ্ধিক অবস্থায় পৌঁছিয়ে ছিল না তেমন ভাবে। তারও আগে সিন্ধু সভ্যতায় মানুষ আধুনিক নগরায়ন গড়ে তুলেছিল। যদিও মেসোপটামিয়ান সভ্যতায় তারও আগে মানুষ কৃষিকার্য শুরু করে দিয়েছিল বলে জানা যায়। এই প্রশ্ন তোলার অভিজ্ঞতা থেকেই অন্যান্য সভ্যতারও সূত্রপাত ঘটে। মায়া সভ্যতা পারস্য সভ্যতা বৈদিক সভ্যতা গ্রীক সভ্যতা। রোমান সভ্যতা। এজটেক ও ইনকা সভ্যতা। কিন্তু লক্ষণীয় বিষয় হলো। যখন থেকেই এই প্রশ্ন তোলার নিরন্তর অভ্যাস থেকে মানুষ পিছিয়ে গিয়েছে। সে যে কোন কারণেই হোক। একে একে এক একটি বড়ো ও সমৃদ্ধশালী সভ্যতা হারাতে হারাতে প্রায় নিঃশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। ইতিহাসের দিকে তাকালে দেখা যাবে। বৈদিক সভ্যতা ও গ্রীক সভ্যতায় নিরন্তর প্রশ্ন তোলার এই সংস্কৃতি ও অভ্যাস চুড়ান্ত শিখরে পৌঁছিয়েছিল। সেই কারণেই আজকের আধুনিক বিশ্বের ভিতে এই দুই সভ্যতার অবদানই সমধিক। সঙ্গে চৈনিক সভ্যতার নামও করতে হবে। কিন্তু অন্যান্য সভ্যতাগুলি যেমন উন্নতও হয়ে উঠেছিল তেমনই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়ে একেবারেই প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে। পড়ে রয়েছে কিছু স্থাপত্য নিদর্শন মাত্র। এর প্রধান কারণ একটাই। তারা প্রশ্ন তোলার নিরন্তর অভ্যাসটুকু হারিয়ে ফেলেছিল। আজকের আধুনিক বিশ্ববন্দোবস্তে তাদের বিশেষ কোন অবদানই নাই। যেমনটা রয়েছে গ্রীক ও বৈদিক সভ্যতার। কিছুটা চৈনিক সভ্যতার। যদিও তা চীনের ভিতরেই সীমাবদ্ধ মূলত।
বিশ্বের ইতিহাসের কথা থাক। আমরা বরং আমাদের ঘরের দিকে তাকাই। বাংলা যে ভারতীয় সভ্যতার অংশ। সেই সুপ্রাচীন ভারতীয় সভ্যতা প্রশ্ন তোলার এই অভ্যাসকে এমন এক শিখরে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল, যেখানে উপনিষদের মতো জ্ঞানভাণ্ডার সৃষ্টি করে যেতে পেরেছিল। তারপরে জ্ঞান বিজ্ঞান দর্শন শিক্ষা স্বাস্থ্য চিকিৎসা বিজ্ঞান স্থাপত্য সাহিত্য ইত্যাদি সকল বিষয়ে এই সভ্যতা এগিয়ে গিয়েছিল। যখন বাকি বিশ্ব বহু যুগ পিছনে পড়েছিল। কিন্তু সেই ভারতীয় সভ্যতাও প্রশ্ন করা ও প্রশ্ন তোলার নিরন্তর অভ্যাসকে সজীব রাখতে ব্যার্থ হয় এক সময়ে। যার ফলে একদিন তাকে সাগরপারের ব্রিটিশের কাছেও পরাধীনতা স্বীকার করতে হয়। শুরু করতে হয় ইউরোপীয়ান পাঠশালায় নতুন করে বিদ্যাশিক্ষার অভ্যাস। যে অভ্যাসে অভ্যস্থ হয়েই আমরা কত সহজে মনে করি, ভাগ্যে ব্রিটিশ এসেছিল এদেশে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিল। ইংরেজি ভাষায় পঠন পাঠন চালু করেছিল। রেলপথ নির্মাণ সমুদ্র ও বিমানবন্দর নির্মাণ করেছিল। পীচ রাস্তা তৈরী করে গিয়েছিল। আধুনিক হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করে ইউরোপীয় চিকিৎসা বিজ্ঞানকে এই দেশে নিয়ে এসেছিল। না হলে আমরা নাকি আজও পাড়াগাঁয়ের অশিক্ষিত হয়ে পড়ে থাকতাম। অর্থাৎ প্রকারন্তরে আমরা স্বীকার করে নিয়েছি যে, আমাদের ভিতরে প্রশ্ন তোলার অভ্যাস ও প্রশ্ন করার মানসিকতাই হারিয়ে গিয়েছিল। ব্রিটিশের হাতে পরাধীন হওয়ার পূর্ববর্তী সময়ে। এবং আমরা এও ধরে নিয়েছি। ব্রিটিশ না আসলে আমরা আধুনিক বিশ্বের উপযুক্ত হয়ে উঠতাম না। কেননা আমরা ইংরেজি ভাষায় শিক্ষিত হতাম না। ফলে ইউরোপীয় জ্ঞানভাণ্ডারের দরজা আমাদের কাছে খুলে যেত না। ইংরেজিকে অবলম্বন করেই ইউরোপের জ্ঞানভাণ্ডারের কাছে পৌঁছাতে পেরেছি আমরা। কিন্তু সে’তো মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী হলেই হয়। উন্নত সমাজ ও সভ্যতার আদব কায়দার নকল নবিশি করলেও অনেকটা মানসম্মত ভাবে নিজেকে সুসভ্য মনে করা যায়। যে কারণে আমাদের সমাজে নাগরিক জীবন ও গ্রামীন জীবনের ভিতরে এমন আকাশ পাতাল ফারাক। নাগরিক শিক্ষায় একবার শিক্ষিত হয়ে গেলেই আমরা আর গ্রামীন সমাজকে নিজেদের আপন বলে অনুভব করতে পারি না। কারণ সেই সমাজ আমাদের চোখে ততটা আর সুসভ্য বলে দেখা দেয় না। সেটা যতটা না গ্রামীন সমাজের দায়। তার থেকে অনেক বেশি দায় আমাদের দেখার চোখের। আমাদের দৃষ্টি শক্তির অক্ষমতার। যে অক্ষমতার জন্ম, এক দিকে মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শীতা ও অন্যদিকে নকল নবিশির অভ্যাসের কারণেই ঘটে।
আমরা কি আজও প্রশ্ন করায় অভ্যস্ত? আজও কি আমাদের মানসিকতায় প্রশ্ন তোলার সংস্কৃতি জন্ম নিয়েছে? বলতে চাইছি সার্বিক ভাবে সমাজ ও জাতির কথাই। দুই একজন ব্যাতিক্রমীদের কথা নয়। আমরা তো সেক্সপীয়রের ইংরেজি থেকে মিলটন ওয়ার্ডসওয়ার্থ শেলী কীটস সব গুলে খেয়েছি। আমাদের হাতে হাতে স্মার্টফোন। ঘরে ঘরে ইনটারনেট। প্রশ্ন তোলার মানসিকতাই প্রকৃত শিক্ষিত হয়ে ওঠার প্রথম ও শেষ ধাপ। এই মানসিকতা না থাকলে মানুষ শুধু ডিগ্রী লাভের জন্যই বিদ্যালয়ের চৌকাঠ পার হয়। শিক্ষিত হয়ে ওঠার সাধনায় বসে না। সে মুখস্থ করে। সে নকল নবিশি করে। সে কোন কিছু সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়ে ওঠে না। সে অন্যের দেখে দেখে পরীক্ষার খাতায় টুকে পাশ করার মতোন করে অনেক কিছু নির্মাণ করে মাত্র। সত্য অর্থে কিছু গড়ে তুলতে পারে না। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে যা কিছুরই প্রয়োজন পড়ছে এখন। যে গুলি না থাকলে আমাদেরকে গণ্ডগ্রামের অশিক্ষিত গরীব মানুষদের মতো জীবনযাপন করতে হতো প্রায়। সেই সবকিছুরই একটি পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুত করতে পারলে দেখা যেত, তার কোন একটিরও সৃষ্টি আমাদের হাতে নয়। সবকিছুরই সৃষ্টি সাগরপারের ইউরোপ আমেরিকা ইজরায়েল অস্ট্রেলিয়া নয়তো চীন কিংবা জাপানে। এই, যে মাধ্যমে এই লেখাটি লিখতে হচ্ছে। সেটিও মাইক্রসফ্টের অবদান। আর যদি আদি ও অকৃত্রিম কাগজ কলমেও লেখা যেত। সেই কাগজ কিংবা কলম। কোনটারই আবিষ্কার আমাদের দ্বারা হয়নি। সেও আমাদের নকল করতে হয়েছে। হ্যাঁ আমরা নকলে পারদর্শী। আমরা মুখস্থ বিদ্যায় বলীয়ান। ফলে আমরা যদি কোন বিষয়ে কোন প্রশ্নও তুলি। সেই প্রশ্নও আমাদের আমদানী করতে হয় পাশ্চাত্য মিডিয়া থেকে। এর থেকে শোচনীয় অবস্থা আর কি হতে পারে?
আগেই বলেছি, প্রশ্ন তোলার মানসিকতাই প্রকৃত শিক্ষিত হয়ে ওঠার প্রথম ধাপের মতোই শেষ ধাপও বটে। কারণ শিক্ষার একটিই কথা নিরন্তর প্রশ্ন তুলে যাওয়া। একজন প্রকৃত শিক্ষিত মানুষের পক্ষেই সম্ভব নিরন্তর ভাবে এই প্রশ্ন তুলে যেতে পারা। তাকে অন্যের তোলা প্রশ্নকে ধার করে কাজ চালাতে হয় না। অন্যের খুঁজে পাওয়া উত্তরকে আমদানী করে জীবনযাপন করতে হয় না। সে সাবলম্বী হয়ে ওঠে তখন। সে আর ততটা পরনির্ভর থাকে না। একথাও ঠিক বিশ্বজুরে বিভিন্ন সমাজ ও জাতি পরস্পরের ভিতরে প্রশ্ন ও উত্তরের আদান প্রদান করবে। না হলে বিশ্ব সভ্যতাও একদিন অবলুপ্ত হয়ে যাবে। কিন্তু আদান প্রদানের দুইটি দিকের ভিতর একটা কাম্য ভারসাম্য থাকা দরকার। শুধুই যদি আমরা নিয়ে যেতেই থাকি। কোন কিছুই দেওয়ার মতো অবস্থায় গিয়ে পৌঁছাতে না পারি। তবে সেখানেই আসল পরাধীনতা। পরাধীনতা মানেই কিন্তু রাজনৈতিক পরাধীনতা নয়। রাজনৈতিক পরাধীনতা সাময়িক বিষয়। কিন্তু কেবলমাত্র ধার করে চলার যে পরাধীনতা, তা কিন্তু নিরন্তর চলতেই থাকে। সেই পরাধীনতার হাত থেকে মুক্ত হতে গেলে। শুরু করতে হবে একেবারে গোড়া থেকে। যে কথা বলে শুরু হয়েছিল এই আলোচনা। সেই প্রশ্ন করার মানসিকতা। আর নিরন্তর প্রশ্ন করার অভ্যাস। উত্তর খুঁজে পাওয়ার অদম্য তাগিদ।
“দুই”
সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি তাদের উপনিবেশ ও বাজারকে নিজেদের কব্জায় ধরে রাখতে প্রশ্ন করার এই মানসিকতা ও অভ্যাসকেই সমূলে বিনষ্ট করে দিতে সদা জাগ্রত থাকে। এই কাজ তারা নানান ভাবে করে চলে। একটা নিদর্শন আমাদের দেশেই রয়েছে। মেকলে প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা। যা সমগ্র সমাজকেই মূলত এমন ভাবেই অর্ধশিক্ষিত এবং অশিক্ষিত করে রাখে যে, সমাজ আর প্রশ্ন তুলতে সক্ষম হয় না। এবং তোলার কথাও সমাজের মনে উদয় হয় না। সে আনুশাসনে চলতেই অভ্যস্থ হয়ে যায়। তাকে যা মুখস্থ করার নির্দেশ দেওয়া হয়। সে সেইটাই মুখস্থ করে নিয়ে গর্বিত হয়ে ওঠে। তাকে টুকে পাশ করায় পারদর্শী করে তোলা হয়। তাকে নকল নিবিশিতে প্রলুব্ধ করে বশ্যতা স্বীকারে অভ্যস্থ করে দেওয়া হয়। ফলে সেই সমাজ ও জাতিকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলি খুব সহজেই নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে পারে। গোটা বিশ্বজুড়েই এই বন্দোবস্ত কায়েম রয়েছে। এবং এরই সাথে আরও একটি কার্যক্রম চালানো হয় সমান্তরাল ভাবে। একদিকে মেকলীয় শিক্ষা পদ্ধতি। অন্যদিকে শাসক নিয়ন্ত্রীত প্রচার মাধ্যম। যে শাসককে আবার নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অক্ষ।
ঠিক এইখানেই তথাকথিত পাশ্চাত্য মিডিয়ার দুনিয়াজোড়া খ্যাতি প্রতিপত্তি ও প্রাসঙ্গিকতা। লক্ষ্মণীয় বিষয় হলো। বিগত প্রায় চার দশক জুড়ে পাশ্চাত্য মিডিয়ার একাধিপত্যের বাইরে আর কোন স্পেস অবশিষ্ট নাই। ফলে এই পাশ্চাত্য মিডিয়া যাদের নিয়ন্ত্রণে। তদের হাতেই প্রায় গোটা বিশ্বের নিয়ন্ত্রণ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তির অক্ষ তাদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও বাজার দখলের স্বার্থে পাশ্চাত্য মিডিয়াকে যেভাবে চালাতে থাকে, পাশ্চাত্য মিডিয়া আমাদের প্রশ্ন তোলার মানসিকতাকে ও অভ্যাসকে সেই ভাবেই খর্ব করার কাজ করে যেতে থাকে। এবং শুধুই পাশ্চাত্য মিডিয়াই নয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অক্ষের গুডবুকে থাকা বিভিন্ন রাষ্ট্রের শাসকবর্গও নিজ নিজ দেশের মিডিয়াকে এই পাশ্চাত্য মিডিয়ার সমান্তরালে চালিত করতে থাকে। পাশ্চাত্য মিডিয়ার স্বার্থেই কাজ করতে থাকে। এবং সুকৌশলে কিংবা সরাসরি নিজ দেশের সমাজ ও জাতিকে প্রশ্ন করার মানসিকতা ও অভ্যাস থেকে দূরবর্তী করে রাখতে সজাগ থাকে। এতে শাসকের মসনদে থাকার কাজটিও অনেক সহজ হয়ে যায়। এই বিষয়টি একবিংশ শতকে এসে প্রায় নিঃশ্ছিদ্র এবং সর্বাত্মক এক রূপ ধারণ করে ফেলেছে।
দেশ স্বাধীন হলেও। সমাজ স্বাধীন হয়নি। ব্রিটিশের জায়গায় এসে বসেছে দেশীয় শাসকশ্রেণী। হাতে হাতে হাত ধরেছে বণিক শ্রেণীর। ফলে এই শাসক ও বণিক শ্রেণীর যৌথ কব্জায় গোটা দেশ ও সমাজ। কথায় বলে যে যায় লংকায়। সেই হয় রাবণ। কথাটা মিথ্যেও নয়। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সাধারণ মানুষও শাসন ক্ষমতায় নির্বাচিত হলে, সেও এই শাসক ও বণিক শ্রেণীর হয়েই কাজ করতে থাকে। সে কখনোই জনতার হয়ে কাজ করে না। ভারতবর্ষ বর্তমানে এক অভুতপূর্ব অবস্থায় এসে পৌঁছিয়েছে। শাসক ও বণিক শ্রেণীকে আর বিশেষ করে আলাদা করে চিহ্নিত করাই মুশকিল। বণিকের মানদণ্ডই আজ গণতান্ত্রিক শাসনদণ্ড রূপে দেশের অধিকার নিয়ে নিয়েছে নিজেদের কব্জায়। এই প্রক্রিয়া নিশ্চয়ই একদিনেই সফল হয়নি। দীর্ঘ সাত দশক জুড়ে এই প্রক্রিয়া কাজ করতে করতে আজ সাফল্যের চুড়ায় অবস্থান করছে। যেখানে, যে বণিক শ্রেণীর কব্জায় দেশের শাসন ব্যবস্থা। সেই একই বণিক শ্রেণীর কব্জায় দেশের মিডিয়া। ফলে সেই মিডিয়াই চব্বিশ ঘন্টা ধরে মানুষের প্রশ্ন তোলার মানসিকতা ও অভ্যাসকে প্রতিহত করে চলেছে। প্রতিহত করছে প্রধানত দুটি উপায়ে। একটা হলো, প্রশ্ন করার অভ্যাস ও মানসিকতাকে নানান কৌশলে ধর্ষণ করে। আর সাম্প্রদায়িকতার নিরন্তর চর্চার ভিতর দিয়ে। মানুষকে একবার কয়েকটি গোষ্ঠীতে ভাগ করে দিতে পারলেই। তার প্রশ্ন করা ও তোলার মানসিকতার মূলেই কুঠারাঘাত করা সম্ভব হয় সহজে। মানুষ তখন গোষ্ঠীর সংস্কৃতির বাইরে বেরোতে পারে না। সেই সংস্কৃতির ধারাতেই দুইবেলা ওঠবোস করতে থাকে। ঠিক এই কাণ্ডই ঘটে পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক বন্দোবস্তে। না, এমন কি সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির দেশগুলিও এই ঘটনার কোন ব্যাতিক্রম ঘটাতে পারেনি। সেখানেও গোষ্ঠী মতবাদেই মানুষকে ডন বৈঠক দেওয়ানো হতো।
এখন মানুষ যদি প্রশ্ন তুলতেই ভয় পায়? তখন কি হবে? সকলেই যে প্রশ্ন করার মানসিকতা হারিয়ে ফেলবে। তেমনটা তো নাও হতে পারে। অনেকের ভিতরেই যদি প্রশ্ন তোলার একটা শক্তি সঞ্চারিত থাকে তবে সেই শক্তিকে তো বলশালী করে তোলা দরকার। বণিকের যে মানদণ্ড গণতান্ত্রিক শাসনদণ্ড রূপে কাজ করতে থাকে। সেই শক্তিই তখন নানান ভাবে ভয় দেখাতে শুরু করে। প্রথমে ছলে বলে কৌশলে। তারপরে সরাসরি দমন নীতির ভিতর দিয়ে। আমাদের ভারতবর্ষে এই কারণেই এক দিকে মিডিয়া আর এক দিকে ইউএপিএ। দুই দিক দিয়েই স্বাধীন মানুষের স্বাধীন প্রশ্ন তোলার সাহসকেই কেড়ে নেওয়ার সুন্দর বন্দোবস্ত কায়েম রয়েছে। যখনই কোন মানুষকে প্রশ্ন তুলতে দেখা যাবে। তখনই শাসকবর্গের মিডিয়া তাঁর উপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে চোখ রাঙাতে শুরু করে দেবে। এমন ভাবেই দেবে যাতে মানুষের সব সাহসই কর্পুরের মতো উড়ে যায়। রক্তকরবী’র রবীন্দ্রনাথের ভাষায় বলতে গেলে বলতে হয়, এ এমনই এক দানব, যে জাদু জানে, শুধু জোর নয় একেবারে ভরসা পর্য্যন্ত শুষে নেয়। বিশেষ করে বিগত সাত বছরে ভারতীয় মিডিয়া এই কাজটি করে চলেছে অনেকটাই দক্ষতার সাথে। যেখানে যেখানে ফাঁক ফোঁকর রয়েছে, সেখানে সেখানে ইউএপিএ দিয়ে নয়তো একেবারে গৌরী লঙ্কেশের দশার মতো লঙ্কাকাণ্ড ঘটিয়ে দেওয়ার শক্তিতে শান দেওয়ার কাজ চলছে দুইবেলা।
ফলে ক্ষেত্র বিশেষে মানুষের ভিতরে প্রশ্ন তোলার মানসিকতা থাকলেও। সেও ভয় পেতে শুরু করে দিয়েছে্। সে মিডিয়ার প্রচারের বাইরে অন্য কোন আলোচনায় যেতেই আর রাজি নয়। হ্যাঁ, মিডিয়ার হ্যাঁতে হ্যাঁ বলে যত বেশি করে ঢাকে তাল তোলা যায়। তাতে মানুষের উৎসাহ উদ্দীপনার কোন ঘাটতি নাই। তাতে প্রাণসংশয়ও নেই। বরং আখের গুছিয়ে তোলার অনেক দরজা খুলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু মিডিয়ার প্রচারের বিরুদ্ধে যায়। এমন কোন প্রশ্ন তোলা। এমন কোন আলোচনা শুরু করার বিষয়ে অধিকাংশ মানুষই আজ ভীত সন্ত্রস্ত। সেই প্রশ্ন দেশের শাসকের সম্বন্ধেই হোক আর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি অক্ষের সম্বন্ধেই হোক। দেশীয় মিডিয়া এবং পাশ্চাত্য মিডিয়ার প্রচারের গণ্ডীর বাইরে কোন পা রাখা যাবে না। একুশ শতকের, এটাই বিটুইন দ্য লাইন মূল গাইডলাইন। এর বাইরে গেলেই চিহ্নিত হয়ে যেতে হবে। অপেক্ষায় থাকতে হবে। আঘাতটা কখন কোনদিক দিয়ে আসবে তার জন্যই।
শিক্ষার পদ্ধতির ভিতর দিয়েই প্রশ্ন তোলার মানসিকতাকে ধ্বংস করে দেওয়া এবং মিডিয়ার প্রচার ও আইন দিয়ে বলপূর্বক প্রশ্ন তোলার সেই অভ্যাসকে প্রতিহত করার নামই কিন্তু ফ্যাসিবাদ। একুশ শতকের বিশ্ব এই ফ্যাসিবাদী শক্তি অক্ষের কব্জায় চলে গিয়েছে। ভারতবর্ষ পশ্চিমববঙ্গ এবং বাংলাদেশ। এই একই ঘটনার বহিঃপ্রকাশ মাত্র। দেশে দেশে বণিকের মানদণ্ড গণতান্ত্রিক শাসনদণ্ড রূপে তার আইনের প্রয়োগ ও মিডিয়ার প্রচারের ভিতর দিয়ে এই ফ্যাসিবাদের কায়েম করে ফেলেছে। তর্কের খাতিরে বলাই যায়। কায়েম করলেও এখনো তাকে অনেক দূর যেতে হবে। কায়েম করার সর্বাত্মক স্বরূপের আত্মপ্রকাশ হতে হয়তো আরও কিছুদিন অপেক্ষাও করতে হতে পারে। কিন্তু একুশ শতকের পৃথিবী তৃতীয় দশকের প্রারম্ভেই সেই পথে পা রেখেছে। শুধুই ভারতবর্ষ বা বাংলা নয়। প্রশ্ন করার মানসিকতাকে আজ বিশ্বশুদ্ধ সর্বত্রই চ্যালেঞ্জের সামনে পড়তে হচ্ছে। যেখানে প্রশ্ন তোলার অভ্যাস মানুষের প্রাণ সংশয় ডেকে আনার দিকে এক নিশ্চিত পদক্ষেপ বলে বিবেচিত হচ্ছে। মানুষ আজ প্রশ্ন তুলতেই ভীত এবং সন্ত্রস্ত। প্রশ্নের সম্মুখীন হতেই নারাজ। নিজের আয়নার সামনে দাঁড়িয়েও সে প্রশ্ন তোলার মকশো করতে ভরসা পাচ্ছে না কোন। তাই সে দুইবেলা মুখস্থ করছে। আর মুখস্থ বলে যাচ্ছে। কেউ কোন প্রশ্ন তুলে দিলেই তার থেকে শতহস্ত দূরবর্তী থাকাকেই নিরাপদ বলে মনে করছে। এইভাবে ক্রমাগত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকার প্রবণতাই কিন্তু একদিন সভ্যতার শেষ ঘন্টা বাজাতে শুরু করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ঠ। তবে ইতিহাসে পূর্বে যখন এক একটি সভ্যতার প্রদীপ নিভেছে। তখন সেটি ছিল মূলত আঞ্চলিক ঘটনা। যোগাযোগ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে সেসময় আবিশ্ব সভ্যতা কোন এক সাধারণ ধর্মে আবদ্ধ ছিল না এখনকার মতো। ফলে এক অঞ্চলের সভ্যতার সঙ্কট গোটা বিশ্বের সভ্যতার সঙ্কট হয়ে দেখা দেয়নি। কিন্তু আজকের কথা ভিন্ন। আজ আর আলাদা করে কোন সভ্যতা নিরাপদ অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারবে না। যখন ধ্বংস হবে। একেবারে সমূলে বিশ্বব্যাপীই সভ্যতা অবলুপ্ত হবে। যদি না আমরা প্রশ্ন তোলার মানসিকতাকে নতুন উদ্যোগে আবার ফিরিয়ে নিয়ে আনতে পারি। যদি না আমরা প্রশ্ন তোলার অভ্যাসকে নিরন্তর জারি রেখে তাকে সর্বাত্মাক ভাবে সংক্রমিত করে তুলতে পারি। যদি না আমরা আমাদের ভিতর থেকে প্রশ্ন তোলাকে সভ্যতার প্রাণ ভোমরা বলে উপলব্ধি করতে পারি।
৭ই জানুয়ারী’ ২০২২
কপিরাইট শ্রীশুভ্র কর্তৃক সংরক্ষিত